islamkingdomfacebook islamkingdomtwitte islamkingdomyoutube

ইখলাস


6228
পাঠ সংক্ষেপ
ইখলাস একটি মহান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।এটি পরিত্যাগ করা অনেক বড় বিপদের কারন। কারণ,আল্লাহ তায়ালা কোন আমল একমাত্র তাঁর জন্য একনিষ্ঠ হওয়া এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পদ্ধতি অনুযায়ী হওয়া ব্যাতীত কবুল করেননা।তাই কোন আমল যতই বড় হোক যদি তাতে আল্লাহ ব্যাতীত অন্য কাউকে শরীক করা হয় তবে তিনি তা কবুল করেননা, অন্যদিকে কোন আমল ছোট হলেও যদি তা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য হয় তবে তিনি তা কবুল করেন।

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَاشَرِيْكَ لَهُ مُخْلِصاً لَهُ الدِّيْنَ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ الصَّادِقُ الْأَمِيَنُ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَالتَّابِعِيْنَ لَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَىَ يَوْمِ الدِّيِنَ، وَسَلَّمَ تَسْلِيْماً كَثِيْراً، أَمَّا بَعْدُ :

সম্মানিত মুসল্লী ভাইয়েরা! আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলব যার অনুপস্থিতিতে বান্দার সকল আমল আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়। এমন একটি বিষয়, যার দ্বারা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, দরজা বুলন্দ হয়। আর এ ক্ষেত্রে ত্রুটি দেখা দিলে বান্দার অধঃপতন ঘটে। আর তা হল ইখলাস।

প্রিয় ভাইয়েরা! ইখলাস একটি মহৎ বিষয়, আমল কবুল হওয়ার অন্যতম এক স্তম্ভ। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দার কোনো আমলই কবুল করেন না যদি তা একমাত্র তাঁরই উদ্দেশ্যে, একমাত্র তাঁকেই রাযি-খুশী করার জন্য সম্পাদিত না হয়। যে আমলে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করা হয়, অন্য কাউকে শরীক করা হয়, যে আমলে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও রেযামন্দী তালাশ করা হয়, সে আমল যত বড়োই হোক বাহ্যিকভাবে যত সুন্দরই হোক আল্লাহর কাছে আদৌ গ্রহণযোগ্য হয় না। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ، أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ}

নিশ্চয় আমি তোমার কাছে যথাযথভাবে এই কিতাব নাযিল করেছি অতএব আল্লাহর ইবাদাত কর তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। জেনে রেখ, বিশুদ্ধ ইবাদাত-আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য (সূরা আয যুমার:৩)

আরো ইরশাদ হয়েছে:

{قُلْ أَمَرَ رَبِّي بِالْقِسْطِ وَأَقِيمُوا وُجُوهَكُمْ عِنْدَ كُلِّ مَسْجِدٍ وَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ كَمَا بَدَأَكُمْ تَعُودُونَ}

বল,আমার রব ন্যায় বিচারের নির্দেশ দিয়েছেন আর তোমরা প্রত্যেক সিজদার সময় তোমাদের চেহারা সোজা রাখবে এবং তাঁরই ইবাদাতের জন্য একনিষ্ঠ হয়ে তাঁকে ডাকবে। যেভাবে তিনি তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন, সেভাবে তোমরা ফিরে আসবে (সূরা আল আরাফ:২৯)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:

{فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ}

সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক, তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে (সূরা গাফির:১৪)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন :

{هُوَ الْحَيُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ}

তিনি চরিঞ্জীব, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা দীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে তাঁকেই ডাক। সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি সৃষ্টিকুলের রব (সূরা গাফির:৬৫)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:

{وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ }

আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয় এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় আর এটিই হল সঠিক দীন (সূরা আল বাইয়িনাহ:৫)

মুহতারাম মুসল্লিয়ান ! আমলের পিছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, বরং একমাত্র লা-শরীক আল্লাহ তাআলাকে উদ্দেশ্য করা, লোক দেখানো এবং মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর মানসিকতা পরিহার করে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনকে উদ্দেশ্য করার নামই হল ইখলাস। আমল যদি ইখলাসশূন্য হয়, ইখলাস থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তা বান্দার পক্ষে না গিয়ে তার বিরুদ্ধে চলে যায়। আবূ হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যার বিচার করা হবে, সে হলো এমন ব্যক্তি, যে শহীদ হয়েছিল। তাকে হাজির করা হবে এবং আল্লাহ তার নিয়ামতের কথা তাকে বলবেন। আর সে তাকে দেয়া সকল নিয়ামতের কথা স্বীকার করবে। তখন আল্লাহ তাকে বলবেন, তুমি কী কাজ করে এসেছ? সে বলবে, আমি আপনার পথে যুদ্ধ করেছি, শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি তো যুদ্ধ করেছ লোকে তোমাকে বীর বলবে, এ উদ্দেশ্যে। আর তা বলা হয়েছে। অতঃপর নির্দেশ দেয়া হবে, এবং তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর এমন ব্যক্তির বিচার করা হবে, যে নিজে জ্ঞান অর্জন করেছে ও অন্যকে শিক্ষা দিয়েছে এবং কুরআন তিলাওয়াত করেছে। তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে তাঁর নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে তা স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি তাকে জিজ্ঞেস করবেন, কী কাজ করে এসেছ? সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করেছি, অন্যকে শিখিয়েছি এবং আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি জ্ঞান অর্জন করেছ এ জন্য যে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলবে। কুরআন তিলাওয়াত করেছ এ উদ্দেশ্যে যে, লোকে তোমাকে কারী বলবে। আর তা বলা হয়েছে। অতপর আল্লাহর নির্দেশে তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তারপর বিচার করা হবে এমন ব্যক্তির, যাকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে সকল ধরনের সম্পদ দান করেছিলেন। তাকে হাজির করে আল্লাহ তার নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন। সে সকল নেয়ামত স্বীকার করবে। আল্লাহ তাআলা বলবেন, কী করে এসেছ? সে বলবে, আপনি যে সকল খাতে খরচ করা পছন্দ করেন আমি তার সকল খাতে সম্পদ ব্যয় করেছি, কেবল আপনারই জন্য। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি সম্পদ এ উদ্দেশ্যে খরচ করেছ যে, লোকে তোমাকে দানশীল বলবে। আর তা বলা হয়েছে। এরপর নির্দেশ দেয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (মুসলিম)

সম্মানিত উপস্থিতি ! একটু ভেবে দেখুন, কুরআন পাঠকারীর জন্য কুরআন সুপারিশকারী হিসেবে হাজির হলো না। অথচ কুরআনওয়ালার জন্য কুরআন সুপারিশকারী হিসেবে হাজির হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে কুরআন সুপারিশ করতে আসেনি। কারণ উল্লিখিত কুরআনওয়ালার ইখলাসের অভাব ছিল। সম্পদশালী ব্যক্তির ব্যয়িত সম্পদও তার কোনো কাজে আসেনি। কারণ তারও ইখলাসের অভাব ছিল। অনুরুপভাবে যুদ্ধের ময়দানে নিহত মুজাহিদও পরিত্রাণ পেলেন না। কেননা তার যুদ্ধ ছিল ইখলাসবিবর্জিত। তাহলে আমরা কোথায়? আমাদের আমল কোথায়? একটু ভেবে দেখুন !

অতএব ইখলাস বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য কর্তব্য। তাই আসুন, এবার জেনে নিই, কোন্ কোন্ বিষয় আমাদের ইখলাস-ঐকান্তিতকায় বিঘ ঘটায়, ইখলাসকে নস্যাৎ করে দিয়ে নেক আমলকে করে দেয় একেবারেই নিরর্থক।

ইখলাস ধ্বংসকারী বিষয়গুলো নিম্নরূপ:

এক. শিরকে আকবার বা বড় শিরক: শিরকে আকবার হলো আল্লাহর সাথে কোনো শরীক বা অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং তার উদ্দেশ্যে আমল নিবেদিত করা। এ ধরনের শিরকের পরিণতি খুবই ভয়াবহ। অর্থাৎ ইসলাম থেকে একেবারে খারিজ হয়ে-যাওয়া পরকালে অনন্ত আগুনে বসবাস নিশ্চিত করা এবং সকল আমল ধ্বংস করে দেয়া।

দুই. শিরকে আসগার বা ছোট শিরক: এটাও ইখলাসের পরিপন্থী। শিরকে আসগার হলো, রিয়া বা লোকদেখানো ও সুনাম কুড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনো নেক-আমল করা। শরীয়তে এটাকেও শিরক বলা হয়েছে, তবে তা একজন মুসলমানকে কাফিরে পরিণত করে না। বরং তা তাওহীদের পূর্ণাঙ্গতাকে আহত করে এবং তা ইখলাসের বিপরীত, যার পরিণতি হল, যে আমলের সাথে তা মিশ্রিত হবে তা বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মাহমুদ ইবনে লাবীদ রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে :

(أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ قَالُوا : وَمَا الشِّرْكُ الأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ، يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِذَا جُزِيَ النَّاسُ بِأَعْمَالِهِمْ، اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ جَزَاءً.)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমি তোমাদের প্রতি সবচে বেশী ভয় করি শিরকে আসগারের। সাহাবীগণ বললেন, শিরকে আসগার কী? হে আল্লাহর রাসূল, তিনি বললেন, তা হল রিয়া। কিয়ামতের দিন যখন মানুষদেরকে তাদের আমলের প্রতিদান দিয়ে দেয়া হবে আল্লাহ তাআলা তখন রিয়াকারীদেরকে বলবেন, দুনিয়ায় যাদেরকে তোমাদের আমল দেখাতে তাদের কাছে যাও, দেখো, তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কি-না (আহমদ, হাসান)

অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি অন্যদেরকে শুনানোর উদ্দেশ্যে নেক-আমল করল, আল্লাহ তা শুনিয়ে দিবেন। আর যে ব্যক্তি অন্যদের দেখানোর উদ্দেশ্যে নেক-আমল করল আল্লাহ তা দেখিয়ে দিবেন (বুখারী)।

অর্থাৎ এ ব্যক্তির নিয়ত অনুযায়ী মানুষদেরকে তার আমল দেখিয়ে দেয়া হবে এবং সে মানুষের প্রশংসাও কুড়াবে, তবে পরকালে তার আমলের বিনিময়ে আদৌ কোনো ছাওয়াব পাবে না।

তিন. আখেরাতের আমল দ্বারা দুনিয়া অর্জনের ইচ্ছা করা। অর্থাৎ আখেরাতের উদ্দেশ্যে যেসব কাজ করা বাঞ্ছনীয় তা পার্থিব সম্পদ, চাকচিক্য ও জৌলুস অর্জনের উদ্দেশ্যে করা। যেমন গনীমতের সম্পদের জন্য জেহাদ করা, সার্টিফিকেট অর্জন ও চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে দীনী ইলম শিক্ষা করা। অবশ্য এ ধরনের কাজের কয়েকটি অবস্থা রয়েছে-

১. আখেরাতের আমল দ্বারা শুধুই দুনিয়া অর্জন উদ্দেশ্য হওয়া, অথবা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় উদ্দেশ্য সমান-সমান থাকা, অথবা আখেরাতের উদ্দেশ্যটা কিছু অংশে বেশি থাকা। উল্লিখিত সকল অবস্থাই ইখলাসপরিপন্থী গোনাহ ও আমল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণ। উবাই ইবনে কাআব রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেন, এ উম্মতকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ, উচ্চাবস্থা এবং দীনের ক্ষেত্রে সাহায্য ও শ্রেষ্ঠত্বের সুসংবাদ দাও। আর তাদের মধ্যে যারা আখেরাতের আমল দ্বারা দুনিয়াবী কাজ করবে, তাদের জন্য আখেরাতে কোনো হিসসা নেই।

২. যদি নেক-আমলের পিছনে পার্থিব ফায়দা হাসিলের ইচ্ছা দীনী ইচ্ছার অধীন হয়, যেমন আল্লাহর ইবাদত পালনের সাথে সাথে শরীয়তের নির্দেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শক্তি সঞ্চয় করাকে উদ্দেশ্য হিসাবে নেয়া হয়, তাহলে তা ইখলাস-পরিপন্থী হবে না। যদিও তা নিখাঁদ ইখলাসযুক্ত আমলের সমপর্যায়ের হবে না।

৩. প্রবৃত্তির অনুসরণ: অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়ন নয় বরং প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা পূরণ করার জন্য কোনো নেক-আমল করা। এ বিষয়টিও ইখলাসের পরিপন্থী ও ক্ষতিকর।

৪. অহঙ্কার-বড়াই প্রকাশের উদ্দেশ্যে আমল করা: অর্থাৎ অহঙ্কার ও দম্ভ-গর্বের অনুভূতি নিয়ে কোনো আমল করা, নিজের আমলকে বড় মনে করা। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে বলা হয় উজব বা আত-তৃপ্তি। নিজ অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতাবশত, বান্দার উপর আল্লাহর নিয়ামত-অনুকম্পা সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে অনেকেই এ অবস্থার শিকার হন। এরূপ অবস্থা রিয়া বা লোক-দেখানোর দোষ থেকেও মারাত্মক। কেননা এ অবস্থায় নিজের নসফের উদ্দেশ্যেই ইবাদত বন্দেগী নিবেদিত হয়। নিজের উজব ও অহঙ্কারী মানসিকতাকে তৃপ্ত করার জন্যই নেক-আমল সম্পাদন করা হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানা এ ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে থাকে না।

যেসব বিষয় ইখলাসের পরিপন্থী নয়:

-পরকালীন উদ্দেশ্য সামনে রাখা, জান্নাত অর্জন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের আশায় নেক-আমল করা।

-যেসব কাজ প্রকাশ্যে করতে হয় সেসব কাজ প্রকাশ্যে করা। গুনাহের কাজ গোপন করা। এরূপ করায় ইখলাস ত্রুটিযুক্ত হয় না। বরং এটাই হবে শরীয়তসম্মত। তাই শরীয়তসম্মত কাজ এই অজুহাতে ছেড়ে দিলে চলবে না, যে তাতে রিয়া-র আশঙ্কা রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বরং ইখলাসের প্রতি গুরুত্বারোপ করে যথারীতি আমল করে যেতে হবে।

-লোকজন যদি বান্দার কোনো নেক-আমলের প্রশংসা করে, যাতে আমলকারীর কোনো প্ররোচনা নেই, তাহলে এটাকে মনে করতে হবে বান্দার জন্য অগ্রিম সুসংবাদ। এতে রিয়া-র কিছু নেই।

আবূ যর রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হল: কোনো ব্যক্তি যদি ভালো কাজ করে এবং সে কাজের জন্য মানুষ তার প্রশংসা করে তাহলে আপনার রায় কি? তিনি বললেন, এটা হলে মুমিনের অগ্রিম সুসংবাদ (মুসলিম )।

-নেক-আমলে শক্তিসঞ্চয়কারী বিষয় যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অধীন হয়, যদি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন এবং আদেশ-নিষেধ পালন মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে এবং ইখলাসের মানসিকতা প্রাধান্যপ্রাপ্ত হয়। যেমন হজ্ব ও ব্যবসা এ উভয় উদ্দেশ্যে হজের সফর করা। আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকে জীবিকানির্বাহের ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা, তাহলে তা ইখলাসের পরীপন্থী হবে না।

-এক ইবাদাতকে অন্য ইবাদাতের সাথে শরীক করা। যেমন রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সাথে সাথে ব্যভিচার থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হৃদয়ে পোষণ করা। এর সাথে ইখলাসের কোনো সংঘর্ষ নেই, বরং তা শরীয়তসম্মত।

-ইবাদত পালন ও মানুষের সাথে দেখাসাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সাজগোজ করা। এটাও ইখলাসের বিপরীতকাজ হবে না। এর উল্টো বরং রিয়া-র ভয়ে দোষত্রুটি প্রকাশ করাই হবে ইখলাসের পরিপন্থী।

-ইবাদতকারী ও সৎবান্দাদেরকে দেখে স্বাভাবিক পরিমাণের তুলনায় ইবাদত-বন্দেগী বাড়িয়ে দেয়া সৎব্যক্তিদের মজলিসের বরকত বলে গণ্য হবে, যা অলসতা ও গাফলতী দূর করে দেয়। আল্লাহর জন্য নিয়ত খালেস থাকলে এখানেও রিয়া-র কোনো দখল নেই।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে যথার্থরূপে ইখলাস অবলম্বন ও তা চর্চার তাওফীক দান করুন।

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ

ইখলাস

দ্বিতীয় খুতবা

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ، وَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِيْنَ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلهَ إِلَّا اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَمَّا بَعْدُ :

সুপ্রিয় মুসল্লীবৃন্দ! ইখলাসের অনেক উপকারিতা রয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো :

-তাওহীদ বাস্তবায়িত হওয়া এবং শিরক ও নিফাক থেকে পরিত্রাণ পাওয়া।

-জান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভ। যদি মুসলমানদের কেউ জাহান্নামে প্রবেশ করে তাহলে বুঝতে হবে সে এতটুকু পরিমাণ ইখলাস অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যা তাকে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ দেবে। তার হৃদয়ে বরং এক প্রকার শিরক ছিল, যা তাকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার উপযোগী করেছে।

-আমল কবুল হওয়া ও বৃদ্ধি পাওয়া।

-শিরক ছাড়া অন্যসব গোনাহ মাফ হয়ে যাওয়া।

-আল্লাহর দাসত্বের স্বাদ অনুভব করা এবং এ ক্ষেত্রে উন্নতিসাধন।

-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত লাভে ধন্য হওয়া।

-দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থলেই পূর্ণ নিরাপত্তা ও হিদায়াত অর্জিত হওয়া।

-খুশি অনুভূত হওয়া, হৃদয়ে আনন্দ আসা, আল্লাহর তাওফীক নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা এবং লজ্জিত ও অপবাদস্থ হওয়া থেকে নিষ্কৃতি লাভ।

-বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া, ফেতনা ও শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে যাওয়া।

-গায়রুল্লাহর দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ।

-মানুষের মহব্বত লাভ এবং তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন।

-আত্মার পরিশুদ্ধি ও কিবর-উজব-রিয়া থেকে পরিত্রাণ।

-আল্লাহর পক্ষ থেকে উম্মতের প্রতি সাহায্য ও প্রতিষ্ঠা আসা ।

সম্মানিত মুসল্লী ভাইয়েরা! ইখলাস পরিপন্থী বিষয় থেকে আমাদের সব সময় সতর্ক থাকা উচিত। আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া উচিত যেন আমাদেরকে তাঁর খাস রহমতে ইখলাস-পরিপন্থী বিষয়সমূহ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। ইখলাস নষ্ট করে দেয় এমন কাজ থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি আদর্শ। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: তোমরা এই শিরককে ভয় করো, যা পিপীলিকার চলার চাইতেও অধিক গোপনে তোমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করবে। এক ব্যক্তি প্রশ্ন করে বলল, যদি তা পিপীলিকার চলার চাইতেও অধিক গোপন হয় তাহলে আমরা কিভাবে তা থেকে বেঁচে থাকব হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, তোমরা বলবে:

(للَّهُمَّ إِنَّا نَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ نُشْرِكَ بِكَ شَيْئًا نَعْلَمُهُ، وَنَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا نَعْلَمُ)

হে আল্লাহ! আমরা জেনেশুনে শিরক করা থেকে আপনার কাছে পানাহ চাচ্ছি। আর যা আমাদের অজানা তা থেকে আমরা আপনার মাগফিরাত চাচ্ছি(আহমদ, হাসান)।

আল্লাহ আমাদের কথা ও কাজ ইখলাসপূর্ণ করুন।

মুহতারাম হাযেরীন ! আল্লাহ আমাদের উপর সন্তুষ্ট হোন, আমরা আল্লাহর সৌভাগ্যবান বান্দা হয়ে যাই এটা আমাদের সবারই হৃদয়ের আওয়াজ।

সবাই চাই আল্লাহর কাছে মাকবুল হতে, আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হতে। আল্লাহর সামনে যখন দাঁড়াব তখন সকল আমল বরবাদ হয়ে যাক, নস্যাৎ হয়ে যাক, এটা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

জাহান্নামের তপ্ত আগুনে অনন্তকাল জ্বলতে-পুড়তে থাকার দৃশ্য সামনে হাজির করুন। নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, এই আগুনে কি অনন্তকাল থাকার মতো শক্তি ও সবর আছে? অথচ প্রকৃত মুমিনরা থাকবে অনন্ত সুখের, অসীম আনন্দের জান্নাতে?

অতঃপর হে আল্লাহর বান্দারা! সতর্ক হোন। সিরিয়াস হোন। নিজদের আমল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন, কোথাও ইখলাসের ত্রুটি আছে কি না, সকল আমল একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত হচ্ছে কি না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন।

اللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الْرَّاشِدِيْنَ وَعَنْ آلِ نَبِيِّكَ الطَّيِّبِيْنَ الطَّاهِرِيْنَ وَعَنْ أَزْوَاجِهِ أُمُّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَعَنْ الصَّحَابَةِ أَجْمَعِيْنَ وَعَنِ التَّابِعِيْنَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنِ وَعَنَّا مَعَهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَعَفْوِكَ وَإِحْسَانِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকলের হৃদয়ে ইখলাস পয়দা করে দিন। ইখলাস-পরিপন্থী সকল নিয়ত ও আমল থেকে আমাদেরকে হিফাযত করুন। আপনিই উত্তম হিফাযতকারী। আপনি আমাদেরকে শিরকে আকবার, শিরকে আসগারসহ সকল প্রকার শিরক থেকে রক্ষা করুন। আপনি আমাদেরকে রিয়া ও উজব থেকে রক্ষা করুন। পার্থিব নিয়তে, দুনিয়ার অর্থসম্পদ যশ-জৌলুস অর্জনের নিয়তে, ইবাদত-বন্দেগী করা থেকে আমাদেরকে হিফাযত করুন। হে আল্লাহ! আপনি মুসলমানদের ইজ্জত ও কদর বাড়িয়ে দিন। আপনি ইসলামকে সমগ্র পৃথিবীতে বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করুন। আপনি ইসলামী আদর্শের অনুশীলন-অনুকরণ ব্যাপক করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকল বৈধ প্রয়োজনগুলো পূরণ করে দিন। আমাদেরকে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করুন। আমাদের দেশকে দারিদ্র্য থেকে রক্ষা করুন। আপনি যে পথে চললে রাযিখুশী হন সে পথে আমাদের দেশের কর্ণধারদের পরিচালিত করুন। আমীন।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : ( إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.