islamkingdomfacebook islamkingdomtwitte islamkingdomyoutube


ভয় ও আশা


9717
পাঠ সংক্ষেপ
অন্তরের আমলসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো আল্লাহ তা‘আলার পাকড়াওয়ের ভয় ও মাগফিরাতের আশা করা। এ ভয় ও আশা এমন এক আমল, যা অন্যান্য নেক-আমালের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে আখিরাতের প্রতি আগ্রহী করে তুলে। পাপাচার ও গুনাহ থেকে মানুষকে দূরে থাকতে সাহায্য করে।

الْحَمْدُ لِلَّهِ غَافِرِ الذَّنْبِ قَابِلِ التَّوْبِ شَدِيْدِ الْعِقَابِ، ذِيْ الطَّوْلِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ إِلَيْهِ الْمَصِيْرُ، أَحْمَدُهُ وَأَشْكُرُهُ أَنْزَلَ الْكِتَابَ نُوْراً مُبِيْناً، يَهْدِي بِهِ اللهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلامِ، وَيُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَىَ النُّوْرِ بِإِذْنِهِ، وَيَهْدِيْهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطاً مُسْتَقِيْماً، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسْولُهُ صَلَّىَ الهُّ وَسَلَّمَ وَبَارَكَ عَلَيْهِ، وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَالتَّابِعِيْنَ لَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيِنِ، أَمَّا بَعْدُ:

প্রিয় মুসলিম ভাই ও বন্ধুগণ! অন্তরের আমলই সবচে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ আমল। অন্তরের আমলের ছাওয়াবও সর্বোচ্চ ও সুদূরপ্রসারী। আবার এ ক্ষেত্রে ত্রুটি হলে তার শাস্তিও অধিকতর মর্মন্তুদ কঠোর। পক্ষান্তরে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল অন্তরের আমলের অনুসারী ও তার উপর নির্ভরশীল। এ জন্যই বলা হয়, অন্তর হলো সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো তার প্রজা। রাজা যেমন তার প্রজাদেরকে পরিচালনা করেন, মানুষের অন্তরও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে পরিচালনা করে। প্রজারা যেমনি রাজার হুকুম তামিল করে তেমনি অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও অন্তরের হুকুম তামিল করে। তাই মানুষের অন্তর যতক্ষণ পর্যন্ত বিশুদ্ধ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার ঈমানও বিশুদ্ধ হতে পারে না। আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(لَا يَسْتَقِيمُ إِيمَانُ عَبْدٍ حَتَّى يَسْتَقِيمَ قَلْبُهُ)

মানুষের ঈমান যথার্থ হবে না যতক্ষণ না তার অন্তর যথার্থ হয় (আহমদ, সহীহ)।

অন্তর যথার্থ হওয়ার অর্থ অন্তরে আল্লাহর তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত থাকা। অন্তরে আল্লাহর আযমত- মহব্বত, বড়ত্ব, ভয় ও আশা প্রতিষ্ঠিত থাকা। অন্তর দিয়ে আল্লাহর আনুগত্যকে পছন্দ করা এবং অবাধ্য হওয়াকে ঘৃণা করা। আবূ হুরাইয়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(ِإنَّ اللَّهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ، وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ، وَأَعْمَالِكُمْ)

নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের আকার-আকৃতি ও সম্পদের প্রতি নজর দেন না। বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল(মুসলিম)।

হাসান আল-বসরী রহ. এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিয়ে বলেন :

دَاوِ قَلْبِكَ، فَإِنَّ حَاجَةَ اللهِ إِلَى الْعِبَادِ صَلَاحُ قُلُوْبِهِمْ

Cতুমি তোমার অন্তরের চিকিৎসা করো কেননা আল্লাহর প্রয়োজন তো কেবল তাঁর বান্দাদের অন্তরের বিশুদ্ধতা।

মুহতারাম শ্রোতামণ্ডলী! অন্তরের আমলসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো আল্লাহ তাআলার পাকড়াওয়ের ভয় ও মাগফিরাতের আশা করা। এ ভয় ও আশা এমন এক আমল, যা অন্যান্য নেক-আমালের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে আখিরাতের প্রতি আগ্রহী করে তুলে। পাপাচার ও গুনাহ থেকে মানুষকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। এ এমন এক আমল, যা মানুষকে দুনিয়ার প্রতি নিস্পৃহ করে তুলে। উদভ্রান্ত পশুপ্রবৃত্তির মুখে লাগাম এঁটে দেয়।

আল্লাহর ভয় অন্তরের চালকতুল্য, যা মানুষকে সকল ভালো কাজের দিকে ধাবিত করে। সকল অকল্যাণ ও বদ-আমল থেকে বিরত রাখে। আর আশা হচ্ছে সম্মুখবর্তী পরিচালক যা বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত নিয়ে যায়। আশা বড় বড় নেক-আমল করার হিম্মত ও সাহস বাড়িয়ে দেয়। বদ-আমল থেকে মানুষকে সরিয়ে আনে।

আল্লাহর ভয় মানবপ্রবৃত্তিকে কামনা-বাসনার ফাঁদ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখে। প্রবৃত্তির বিপথগামিতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রবৃত্তিকে এমন পথে পরিচালিত করে যাতে রয়েছে মানবকুলের কল্যাণ ও সাফল্য। আল্লাহর ভয় তাওহীদের একটি শাখা। তাই ভয় একমাত্র আল্লাহকেই করতে হবে অন্য কাউকে করা যাবে না। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করলে তা হবে শিরকের শামিল।

একমাত্র আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার নির্দেশ

প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুআলানে শুধুমাত্র তাঁকেই ভয় করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য কাউকে ভয় করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّمَا ذَلِكُمْ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِي إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ}

সে তো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, বরং আমাকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হও (সূরা আলে ইমরান:১৭৫)

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেছেন :

{فَلا تَخْشَوْا النَّاسَ وَاخْشَوْنِي وَلا تَشْتَرُوا بِآيَاتِي ثَمَنًا قَلِيلاً}

অতঃপর মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় কর। আর আমার আয়াতসমূহ স্বল্পমূল্যে বিক্রি করো না (সূরা আল মায়েদা)

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে :

{وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ}

আর কেবল আমাকেই ভয় কর (সূরা আল বাকারা:৪০)

হাদীসে এসেছে, আনাস রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা করলেন। অতঃপর বললেন :

(لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا، قَالَ: فَغَطَّى أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللُه عَلِيْهِ وَسَلَّمْ وُجُوهَهُمْ لَهُمْ خَنِينٌ)

আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তাহলে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। তখন সাহাবীগণ তাঁদের চেহারা ঢেকে ফেললেন এ অবস্থায় যে তাঁরা ছিলেন কান্নারত (বুখারী ও মুসলিম)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মিরাজের রাতে জাহান্নামীদের কষ্ট-আযাব স্বচক্ষে দেখেছেন। উপরন্তু আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে তাঁকে পরকালীন জীবনের খুঁটিনাঁটি সবিস্তারে জানিয়েছেন। পরকালীন জীবন ও পাপীদের জন্য সেখানে যে কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে জানতেন অন্যান্য মানুষ যদি সেভাবে জানতো তবে মানুষের আমোদ-আহলাদ, হাসি-তামাশা সব থেমে যেত। বরং সবাই উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায়, ভয়ে, শঙ্কায় কেঁদে কেঁদে অধিক সময় পার করত।

আল্লাহর ভয় একটি মৌলিক বিষয়। আল্লাহর ভয় থেকে যাদের হৃদয় শূন্য তারা দুনিয়াতেও বিপথগামী, পরকালেও তারা বঞ্চিত হবে জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে। তাই আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করার অন্য কোনো বিকল্প নেই। আর এর জন্য প্রয়োজন যথার্থ জ্ঞানার্জন। কেননা আল কুরআন অনুযায়ী জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ}

বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লহকে ভয় করে (সূরা আল ফাতির : ২৮)

যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য আল্লাহ তাআলা জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। কেননা আল্লাহকে ভয়কারী কখনো আল্লাহর নাফরমানী করতে পারে না পাপাচার করতে পারে না। পাপের দিকে পা বাড়ালেই আল্লাহর ভয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহকে ভয়কারীর জীবন হয় পূন্যময় জীবন। আর যারা এভাবে জীবনযাপন করে পরপারে যাবে তাদের জন্য তো জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত। ইরশাদ হয়েছে :

{وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ. فَبِأَيِّ آلاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ. ذَوَاتا أَفْنَانٍ}

আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে, তার জন্য থাকবে দুটি জান্নাত। সুতরাং তোমাদের রবের কোন্ নিআমতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? উভয়ই বহু ফলদার শাখাবিশিষ্ট (সূরা আর রাহমান:৪৬-৪৮)

যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে সে নিজের খেয়াল-খুশিমতো চলতে পারে না বরং নিজের খেয়াল-খুশিকে আল্লাহর রেযামন্দীর অনুগামী করে দেয়। আর আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের খেয়াল-খুশিকে বিসর্জনের প্রতিদান তো জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে :

{وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنْ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى}

আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল (সূরা আন-নাযিআত:৪০-৪১)

দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর ভয়ে শঙ্কিত জীবনযাপনের পর সৎকর্মশীল মুমিনরা যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, পৃথিবীতে পরিবার-পরিজনবেষ্টিত থাকা অবস্থায় তারা যে আল্লাহকে ভয় করত, সে বিষয়টি পরস্পরে আলোচনার সময় উল্লেখ করবে। ইরশাদ হয়েছে :

{وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ}

আর তারা একে অপরের মুখোমুখী হয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে, তারা বলবে, পূর্বে আমরা আমাদের পরিবারের মধ্যে শঙ্কিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন এবং আগুনের আযাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় পূর্বে আমরা তাঁকে ডাকতাম নিশ্চয় তিনি ইহসানকারী, পরম দয়ালু (সূরা আত-তূর:২৫-২৮)

সালাফে সালেহীনদের জীবন ছিল আল্লাহর ভয়পূর্ণ জীবন। তাঁদের হৃদয়রাজ্যে ছিল আল্লাহর ভয়ের শাসন। তাঁরা ছিলেন নেককার ও আল্লাহর রহমত-প্রত্যাশী বান্দা। এ কারণেই তাঁদের পার্থিব জীবনটাও ছিল উত্তম জীবন। আর পরকাল তো তাদের চির সুখের ঠিকানা। উমর রাযি. রাতের বেলায় ঘুরে বেড়াতেন সাধারণ মানুষের অবস্থা জানার জন্য। একদিন তিনি এক ব্যক্তিকে সূরায়ে তূর পড়তে শুনে তাঁর বাহন থেকে নেমে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। এরপর তিনি দীর্ঘ একমাস অসুস্থাবস্থায় ছিলেন। উমর রাযি. এর কি রোগ হয়েছে তা কেউ জানতে পারেনি। সুফিয়ান আছ-ছাওরী রহ. আল্লাহর ভয়ে একবার রীতিমতো অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। সালাফে সালেহীনের জীবনে এ জাতীয় বহু উদাহরণ রয়েছে, যা এই ছোট্ট পরিসরে উল্লেখ করা সম্ভব নয়।

আবূ হাফস রহ. বলেন: ভয় হচ্ছে আল্লাহর চাবুক। যারা আল্লাহর দরজা থেকে দূরে তিনি তাদেরকে এই চাবুক দ্বারা সোজা করেন। তিনি আরো বলেন: ভয় হলো অন্তরের চেরাগ। আবূ সুলায়মান রহ. বলেন : ভয় যদি কারো হৃদয় ছেড়ে চলে যায়, তবে সে ধ্বংস হয়ে যায়।

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ، أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالمَيْنَ، أَحْمَدُهُ سُبْحَانَهُ وَأَشْكُرُهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ صَلَّى اللهُ وَسّلَّمَ وَبَارَكَ عَلِيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأصْحَابِهِ وَالتَّابِعَيْنَ لَهُمْ بِإِحْسَانٍ إَلَى يَوْمِ الدِّيْنِ،أَمَّا بَعْدُ:

পিয় ভাইয়েরা! প্রশংসিত ভয় তো হলো তাই, যা মানুষকে সৎকাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। সৎকাজের প্রেরণা যোগায়। হারাম কাজ থেকে বিরত রাখে। তবে ভয় যদি প্রশংসনীয় পর্যায় অতিক্রম করে অতিমাত্রায় প্রচণ্ডতা ধারণ করে তবে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আর আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া কবীরা গুনাহ।

ইবনে রজব রহ. বলেন, যতটুকু ভয় থাকা ওয়াজিব বা আবশ্যক তা হলো, এমন ভয় যা মানুষকে ফরয ও আবশ্যক বিষয়গুলো যথার্থরূপে আদায় করা এবং হারাম থেকে বেঁচে থাকার প্রতি উৎসাহিত করে। ভয় যদি এর থেকে অতিরিক্ত আকারে থাকে, যা মানুষকে নফল ও ঐচ্ছিক আমলগুলো বাস্তবায়ন এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাকরূহ ও যা করা জায়েয এমন জিনিসের সংস্পর্শ থেকে ব্যক্তিকে বিরত রাখে, তবে তা এক প্রশংসনীয় গুণ। কিন্তু যদি ভয়ের মাত্রা এর থেকেও বেড়ে যায়, যেমন ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে কেউ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লো, অথবা ভয়ে-শঙ্কায় মারাই গেল অথবা সারাক্ষণ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলো। এমনকি ভয় তাকে শ্রম থেকে বিমুখ করে দিল, তাহলে এমন ভয় অপ্রশংসনীয় ভয় বলে গণ্য হবে।

তাই আল্লাহ তাআলাকে ভয় করার ক্ষেত্রেও আমাদেরকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হবে। এমন ভয় না করা, যা বান্দাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করে দেয়। অথবা আমলের ক্ষেত্রে শ্রম ব্যয়ের মানসিকতায় ব্যত্যয় ঘটিয়ে একেবারে কর্মবিমুখ করে দেয়।

সুপ্রিয় মুসল্লীবৃন্দ! একজন মুমিন দুই ধরনের ভয়ের মাঝে জীবনযাপন করে। এক. এমন বিষয়ের ভয় যা বিগত হয়েছে, বান্দা জানে না সে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা কী ফয়সালা করে রেখেছেন। দুই. এমন বিষয়ের ভয় যা এখনো সংঘটিত হয়নি। বান্দা জানে না, আল্লাহ তার ভাগ্যে এ ব্যাপারে কী লিখে রেখেছেন।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! এবার আসুন আশা নিয়ে আলোচনা করি। আশা হলো নেক-আমলের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাওয়াব প্রাপ্তির আশা রাখা। ছাওয়াব প্রাপ্তির আশা রাখার শর্ত হলো, প্রথমে নেক-আমল সম্পাদন করা। হারাম থেকে বিরত থাকা ও তাওবা করা। এর বিপরীতে যদি কেউ আবশ্যককর্ম ছেড়ে দিয়ে নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে শুরু করে এবং আল্লাহর উপর অযাচিতভাবে আশা করে বসে থাকে, তবে তার অর্থ হবে আল্লাহর পাকড়াও ও কৌশল সম্পর্কে নিরাপত্তা অনুভব করা, যা কোনো ক্রমেই আশার মধ্যে পড়ে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :

{فَلا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ}

তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ হয়ে গিয়েছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত কওম ছাড়া আল্লাহর কৌশল থেকে আর কেউ (নিজদেরকে) নিরাপদ মনে করে না (সূরা আল-আরাফ:৯৯)।

আগে নেক-আমল করতে হবে তারপর আশায় বুক বেঁধে রাখতে হবে। নেক-আমল না করেই রঙ্গীন আশায় বিভোর হয়ে থাকা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّ الَّذِينَ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَأَنْفَقُوا مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ سِرًّا وَعَلانِيَةً يَرْجُونَ تِجَارَةً لَنْ تَبُورَ}

নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, সালাত কায়েম করে এবং আল্লহ যে রিয্ক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না (সূরা ফাতির:২৯)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে :

{إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُوْلَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَةَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ}

নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে ও যারা হিজরত করেছে এবং আল্লহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, তারা আল্লহর রহমতের আশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা আল বাকারা:২১৮)

আশা-প্রত্যাশা একটি ইবাদত, যা নিবেদিত হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। মুক্তি ও কল্যাণের আশা একমাত্র আল্লাহর সাথেই নির্দিষ্ট করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি আশা-প্রত্যাশার অর্থ হবে আল্লাহর সাথে শরীক করা। ইরশাদ হয়েছে :

{فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحًا وَلا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا}

সুতরাং যে তার রবের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদাতে কাউকে শরীক না করে (সূরা আল কাহ্ফ:১১০)

আশা-প্রত্যাশা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের একটি মাধ্যম। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন

(أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي، وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي)

আমি- আমার ব্যাপারে আমার বান্দার ধারণার কাছে। আর আমি তার সাথে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে (বুখারী ও মুসলিম)।

তাই নেক-আমল পেশ করার পর আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা রাখা অতি জরুরী বিষয়। তাই আমল কবুল হচ্ছে না, অথবা আল্লাহ কোনো ছাওয়াব দেবেন না এ জাতীয় ধারণা পোষণ করা কখনো উচিত নয়।

সুপ্রিয় হাযেরীন! অন্তরে আল্লাহর ভয় ও আশা উভয়টাই সমানভাবে রাখতে হবে। আর বান্দার পূর্ণাঙ্গ অবস্থা তো হলো ভয় ও আশা উভয়টা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় হৃদয়ে ধারণ করে আল্লাহকে মহব্বত করা। নবী-রাসূল ও প্রকৃত মুমিনদের অবস্থা এরূপই ছিল। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন :

{إِنَّهُمْ كَانُوا يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ}

তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করত। আর আমাকে আশা ও ভীতি সহকারে ডাকত। আর তারা ছিল আমার নিকট বিনয়ী (সূরা আল আম্বিয়া:৯০)

তিনি অন্যত্র ইরশাদ করেন :

{تَتَجَافَى جُنُوبُهُمْ عَنْ الْمَضَاجِعِ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وَطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ}

তাদের পার্শ্বদেশ বিছানা থেকে আলাদা হয়। তারা ভয় ও আশা নিয়ে তাদের রবকে ডাকে। আর আমি তাদেরকে যে রিয্ক দান করেছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে (সূরা আস-সাজদা:১৬)

একজন মুসলমান যখন আল্লাহর রহমতের ব্যাপকতা, তাঁর মহানুভবতা, মাগফিরাত, তাঁর জান্নাতের বিশালতা, অফুরন্ত ছাওয়াব ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে, তখন তার হৃদয় প্রশস্ত হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে যে অফুরন্ত খায়ের-বরকত রয়েছে, যে ছাওয়াবনিয়ামত রয়েছে সে ব্যাপারে আশা-প্রত্যাশায় তার বুক ভরে যায়। অপর পক্ষে যখন সে আল্লাহর কঠোর শাস্তি ও পাকড়াও, সীমাহীন আযাব, কঠিন হিসাব-নিকাশ, কিয়ামতের ভয়াবহতা, আগুনের বীভৎসতা, জাহান্নামের আযাবের নানা আকার-প্রকৃতি ইত্যাদির জ্ঞান লাভ করে তখন সে ভয়ে কম্পিত হয়ে পড়ে। তার হৃদয় তখন শঙ্কিত হয়ে যায়। তাই আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الْعُقُوبَةِ مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ، وَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الرَّحْمَةِ مَا قَنَطَ مِنْ جَنَّتِهِ أَحَدٌ )

মুমিন যদি আল্লাহর কাছে কী আযাব রয়েছে তা জানত তাহলে কেউ তার জান্নাতের প্রত্যাশা করত না। আর কাফির যদি জানত আল্লাহর কাছে কী রহমত রয়েছে তবে তার জান্নাত থেকে কেউ নিরাশ হত না (মুসলিম)।

আল্লাহ তাআলাও বহু জায়গায় তাঁর আযাব ও মাগফিরাত পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :

{وَإِنَّ رَبَّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ لِلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبَّكَ لَشَدِيدُ الْعِقَابِ}

আর নিশ্চয় তোমার রব মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল তাদের জুলম সত্ত্বেও এবং নিশ্চয় তোমার রব কঠিন আযাবদাতা (সূরা আর রাদ:৬)

ইমাম গাযালী রহ. মাকহূল আদ-দিমাশকী রহ. থেকে বর্ণনা করেন যে, যে কেবল ভীতি নিয়ে আল্লাহর ইবাদাত করে সে হারূরী ফেরকাভুক্ত। আর যে কেবল আশা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে সে মুরজিআ ফেরকাভুক্ত। আর যে কেবল মহব্বত নিয়ে আল্লাহর ইবাদাত করে সে যিন্দীক। আর যে ভয়, আশা ও মহব্বত নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে সে একত্ববাদী সুন্নী (এহয়ায়ে উলূমুদ্দীন)।

ইমাম ইবনুল কাইয়েম রহ. মাদারিজুস সালেকীন গ্রন্থে বলেন, অন্তর আল্লাহ তাআলার পানে চলার ক্ষেত্রে একটি পাখির তুল্য। মহব্বত হলো এ পাখির মাথা। আর ভয় ও আশা হলো এ পাখির দুই ডানা। যদি মাথা ও দুই ডানা ঠিক থাকে তাহলে সে ভালোভাবে উড়তে পারে। যদি পাখিটির মাথা কেটে ফেলা হয়, তাহলে সে মারা যায়। যদি দুই ডানা কেটে ফেলা হয়, তবে সে প্রত্যেক শিকারীর সহজ লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়। তবে সালাফ তথা আমাদের নেককার পূর্বপুরুষগণ ভয়ের ডানাকে আশার ডানার চেয়ে বেশি শক্তিমান করতে পছন্দ করতেন। আর যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় হত তখন আশার ডানাকে ভয়ের ডানার চেয়ে অধিক শক্তিশালী করতেন। মহব্বত হলো বাহন আশা হলো সম্মুখবর্তী পরিচালক, ভয় হলো পশ্চাৎবর্তী চালক। আর আল্লাহ তাঁর ফযল ও করমে বান্দাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার মালিক।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আমরা যদি আমল না করে কেবল আশায় বুক বেঁধে বসে থাকি, তবে তা হবে নিজেদের সাথেই প্রতারণা করা এবং দম্ভগর্বের প্রকাশ। আর আল্লাহ তাআলা এরূপ করতে আমাদেরকে নিষেধ করে দিয়ে বলেন :

{يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللَّهِ الْغَرُورُ}

হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে আর বড় প্রতারক (শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারণা না করে (সূরা আল ফাতির:৫)

اَللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَعَنْ آلِ نَبِيِّكَ الطَّيِّبِيْنَ الطَّاهِرِيْنَ وَعَنْ أَزْوَاجِهِ أُمُّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَعَنِ الصَّحَابَةِ أَجْمَعِيْنَ وَعَنِ التَّابِعِيْنَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنِ وَعَنَّا مَعَهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَعَفْوِكَ وَإِحْسَانِكَ يَا أَرْحَمَ الْرَّاحِمِيْنَ.

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله ِ: (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.