islamkingdomfacebook islamkingdomtwitte islamkingdomyoutube


সূর্যগ্রহন বা চন্দ্রগ্রহনের সালাত


7921
পাঠ সংক্ষেপ
চাঁদ ও সূর্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর মধ্যে দুটি নিদর্শন। আল্লাহ এ দুটোর আলো ও জ্যোতি সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করে দেন তাঁর অসীম ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে ও বান্দাদের পাপ-গুনাহের প্রতি সর্তকবাণী প্রেরণের উদ্দেশ্যে। যাতে তারা আল্লাহর পানে ফিরে যায়, তাওবা করে, গুনাহ থেকে ক্ষমা চায়। আর এ কারণে তিনি চন্দ্রসূর্যগ্রহণকালীন নামায শরীয়তের আওতাভুক্ত করেছেন, যাতে মানুষ তাঁর কাছে মিনতি করে, অতঃপর তিনি বিপদ থেকে তাদের উদ্ধার করেন।

إِنَّ الْحَمْدَ لِلَّهِ، نَحْمَدُهُ، وَنَسْتَعِيْنُهُ، وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَتُوْبُ إِلَيْهِ، وَنَعُوْذُ بِهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا؛ وَمَن سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مِنْ يَهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ؛ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوُلُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ، وَعَلَى آلِه، وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تَسْلِيْمًا كِثِيْرًا إِلَى يَوْمِ الْدِّيِنِ، أَمَّا بَعْدُ: فَيَا أَيُّهَا النَّاس، اتَّقُوْا اللَّه تَعَالَى حَق التَّقْوَى.

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! রাত ও দিনের আবর্তন আল্লাহ তাআলার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন। রাত ও দিন আল্লাহ তাআলা মানুষের উপকারের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের জন্যই তিনি সৃজন করেছেন আলো ও আঁধার। শুধু রাত ও দিন নয় বরং আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সব কিছুই তিনি নিয়োজিত করেছেন মানুষের সেবায়। ইরশাদ হয়েছে :

{ وَسَخَّرَ لَكُمُ ٱلْفُلْكَ لِتَجْرِىَ فِى ٱلْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ ٱلانْهَارَ. وَسَخَّر لَكُمُ ٱلشَّمْسَ وَٱلْقَمَرَ دَائِبَينَ وَسَخَّرَ لَكُمُ ٱلَّيْلَ وَٱلنَّهَارَ. وَاتَاكُم مّن كُلّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ ٱللَّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ ٱلإنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ. }

‘ আর তিনি সূর্য ও চাঁদকে তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন বিরামহীনভাবে এবং তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে। আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদের দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নিরূপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অধিক অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ’ (সূরা ইবরাহীম: ৩৩-৩৪)।

আল্লাহ তাআলা চাঁদ ও সূর্যকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন যাতে চাঁদের পরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায় থেকে মানুষ দিন-মাস-বছর হিসেব করতে পারে। আর সূর্যকে তিনি নিয়োজিত করেছেন যাতে সূর্যের পরিক্রমার বিভিন্ন পর্যায়ে মৌসুম ভেদে নানা প্রকৃতির ফলফলান্তি জন্ম নিতে পারে। তিনি চাঁদ ও সূর্য উভয়কে চমৎকার এক পদ্ধতিতে চলমান করে রেখেছেন। ইরশাদ হয়েছে :

{ ٱلشَّمْسُ وَٱلْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ}

‘ সূর্য ও চাঁদ (নির্ধারিত) হিসাব অনুযায়ী চলে’ (সূরা আর রাহমান: ৫)।

আল্লাহ তাআলা চাঁদ ও সূর্যকে যে কক্ষপথে চলমান করে রেখেছেন তা থেকে তা বিন্দুমাত্র সরে না। এদিক-সেদিক যায় না। আল্লাহ তাআলার সুনির্দিষ্ট সীমানা তারা কখনো অতিক্রম করে না। আল্লাহ তাআলা কত সুনিপুণ ও নিখুঁতভাবেই না মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছেন ও চলমান করে রেখেছেন।

{ صُنْعَ ٱللَّهِ ٱلَّذِى أَتْقَنَ كُلَّ شَىْء إِنَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَفْعَلُونَ }

‘(এটা) আল্লাহর কাজ, যিনি সব কিছু দৃঢ়ভাবে করেছেন। নিশ্চয় তোমরা যা কর, তিনি সে সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত’ (সূরা আন-নামল:৮৮)।

চাঁদ ও সূর্য আল্লাহ তাআলার সীমাহীন জ্ঞান ও ক্ষমতা, হেকমত ও প্রজ্ঞা, পরম করুণা ও দয়ার নিদর্শন। চাঁদ ও সূর্য তাদের বিশালত্বে আল্লাহর নিদর্শন, তাদের জ্যোতি ও আলোয় আল্লাহর নিদর্শন। ইরশাদ হয়েছে :

{ وَٱلشَّمْسُ تَجْرِى لِمُسْتَقَرّ لَّهَـا ذَلِكَ تَقْدِيرُ ٱلْعَزِيزِ ٱلْعَلِيمِ وَٱلْقَمَرَ قَدَّرْنَـٰهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَٱلعُرجُونِ ٱلْقَدِيمِ. لاَ ٱلشَّمْسُ يَنبَغِى لَهَا أَن تدْرِكَ ٱلقَمَرَ وَلاَ ٱلَّيْلُ سَابِقُ ٱلنَّهَارِ وَكُلٌّ فِى فَلَكٍ يَسْبَحُونَ }

‘আর সূর্য ভ্রমণ করে তার নির্দিষ্ট পথে, এটা মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ (আল্লাহ)Ñর নির্ধারণ। আর চাঁদের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি মানযিলসমূহ, অবশেষে সেটি খেজুরের শুষ্ক পুরাতন শাখার মত হয়ে যায়। সূর্যের জন্য সম্ভব নয় চাঁদের নাগাল পাওয়া, আর রাতের জন্য সম্ভব নয় দিনকে অতিক্রম করা, আর প্রত্যেকেই কক্ষ পথে ভেসে বেড়ায়’ (সূরা ইয়াসীন: ৩৮-৪০)।

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন :

{ وَمِنْ آَيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ }

‘ আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে রাত ও দিন, সূর্য ও চাঁদ। তোমরা না সূর্যকে সিজদা করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত কর’ (সূরা ফুস্সিলাত:৩৭)।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র ইরশাদ করেন :

{ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِيَ فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْأَنْهَارَ. وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ. وَآَتَاكُمْ مِنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِنْ تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا إِنَّ الْإِنْسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ }

‘আর তিনি সূর্য ও চাঁদকে তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন বিরামহীনভাবে এবং তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে। আর তোমরা যা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকে তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন এবং যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা কর তবে তার সংখ্যা নিরুপণ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অধিক অত্যাচারী ও অকৃতজ্ঞ’ (সূরা ইবরাহীম:৩২-৩৩)।

চাঁদ ও সূর্যের পরিক্রমার বিধানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না। সূর্যের জ্যোতি ও চাঁদের আলো বাধাগ্রস্ত করার জন্য আল্লাহ তাআলা রেখেছেন কিছু প্রাকৃতিক কারণ, যা মুমিন ও কাফির সবাই স্বীকার করে থাকে। এর পাশাপাশি তিনি রেখেছেন কিছু ধর্মীয় কারণ, যা কেবল মুমিনরাই স্বীকার করে, কাফিররা করে না। ধর্মীয় কারণের মধ্যে একটি হলো, আল্লাহ তাআলা চাঁদ ও সূর্যগ্রহণের পদ্ধতি রেখেছেন মানুষকে ভীতি প্রদর্শনের জন্য, যাতে তারা সতর্ক হয়ে যায়।

পৃথিবীর সকল কিছুই আল্লাহর নির্দেশের তাবেদার, তাঁর নীতির অনুগত এ বিশ্বাস নতুন করে প্রতিটি ব্যক্তি তার হৃদয়ে জাগ্রত করে নেয়। যিনি প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন তিনি প্রকৃতির কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করতে পারেন, এমনকি কিয়ামত ঘটিয়ে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারেন এবং অবশ্যই ধ্বংস করবেন, এ বিশ্বাস নতুন করে জাগ্রত করে নেয়। আল্লাহর যিকর ও দু‘আ ইস্তিগফারে একাগ্র চিত্তে প্রত্যেকেই নিয়োজিত হয়। হাদীসে এসেছে। আবূ মূসা আশআরী রাযি. বর্ণনা করেন :

( خَسَفَتِ الشَّمْسُ فِي زَمَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَامَ فَزِعًا يَخْشَى أَنْ تَكُونَ السَّاعَةُ، حَتَّى أَتَى الْمَسْجِدَ، فَقَامَ يُصَلِّي بِأَطْوَلِ قِيَامٍ وَرُكُوعٍ وَسُجُودٍ، مَا رَأَيْتُهُ يَفْعَلُهُ فِي صَلَاةٍ قَطُّ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ هَذِهِ الْآيَاتِ الَّتِي يُرْسِلُ اللَّهُ لَا تَكُونُ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلَا لِحَيَاتِهِ، وَلَكِنَّ اللَّهَ يُرْسِلُهَا يُخَوِّفُ بِهَا عِبَادَهُ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ مِنْهَا شَيْئًا، فَافْزَعُوا إِلَى ذِكْرِهِ وَدُعَائِهِ وَاسْتِغْفَارِهِ )

‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একবার সূর্য গ্রহণ লাগল। অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যায় কি না এই ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি মসজিদে এলেন ও নামাযে দাঁড়ালেন। তিনি এমন দীর্ঘ রুকু-সিজদা ও কিয়ামের মাধ্যমে নামায আদায় করলেন যা অন্যকোনো নামাযে দেখিনি। এরপর তিনি বললেন : ‘এই সব নিদর্শন আল্লাহ তাআলা কারো মৃত্যু অথবা জীবনের কারণে প্রেরণ করেন না। তিনি বরং তা প্রেরণ করেন তাঁর বান্দাদেরকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে। তাই তোমরা যদি এর কিছু দেখ তবে ভীত-শঙ্কিত হয়ে আল্লাহর যিকর দু‘আ ও ইস্তিগফারে রত হও’ (মুসলিম)।

যারা আল্লাহ থেকে দূরে, তাঁর দীন থেকে দূরে, যারা আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের স্পর্ধা দেখায় তাদেরকে সতর্ক করার জন্যই আল্লাহ তাআলা চাঁদ ও সূর্য গ্রহণ লাগার নিয়ম রেখেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে প্রচণ্ড গরমের দিনে সূর্য গ্রহণ লাগল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহবীদেরকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। এরপর বললেন:

( إنَّهُ عُرِضَ عَلَيَّ كُلُّ شَيْءٍ تُولَجُونَهُ، فَعُرِضَتْ عَلَيَّ الْجَنَّةُ حَتَّى لَوْ تَنَاوَلْتُ مِنْهَا قِطْفًا أَخَذْتُهُ، أَوَ قَالَ: تَنَاوَلْتُ مِنْهَا قِطْفًا فَقَصُرَتْ يَدِي عَنْهُ، وَعُرِضَتْ عَلَيَّ النَّارُ، فَرَأَيْتُ فِيهَا امْرَأَةً مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ تُعَذَّبُ فِي هِرَّةٍ لَهَا رَبَطَتْهَا، فَلَمْ تُطْعِمْهَا وَلَمْ تَدَعْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الْأَرْضِ، وَرَأَيْتُ أَبَا ثُمَامَةَ عَمْرَو بْنَ مَالِكٍ يَجُرُّ قُصْبَهُ فِي النَّارِ، وَإِنَّهُمْ كَانُوا يَقُولُونَ إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَا يَخْسِفَانِ إِلَّا لِمَوْتِ عَظِيمٍ، وَإِنَّهُمَا آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ يُرِيكُمُوهُمَا، فَإِذَا خَسَفَا فَصَلُّوا حَتَّى تَنْجَلِيَ )

‘ তোমরা যেসবে প্রবেশ করবে তার সবই আমাকে দেখানো হয়েছে। আমার সামনে জান্নাত পেশ করা হয়েছে। এমনকি আমি যদি জান্নাতের কোনো ফলের থোকা ছিঁড়ে আনতে চাইতাম আমি তা পারতাম। তবে আমার হাত তা থেকে বিরত থেকেছে। আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হয়েছে। জাহান্নামে আমি বনী ইসরাইলের এক নারীকে তার একটি বিড়ালকে কেন্দ্র করে আযাবরত অবস্থায় দেখতে পেলাম। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে না খেতে দিয়েছে, আর না তাকে ছেড়ে দিয়েছে যাতে যমীনের পোকা-মাকড় খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে। আমি আবু ছুমামা আমর ইবনে মালেককে দেখেছি, আগুনে সে তার নাড়ীভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। তারা বলত যে, সূর্য ও চন্দ্র কোনো মহান ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে ঘটে থাকে। আসলে এ দু’টো হল আল্লাহর নিদর্শন, যা তিনি তোমাদেরকে দেখান। অতঃপর যদি এ দুটোয় গ্রহণ লাগে তবে তোমরা নামায আদায় কর যতক্ষণ না তা কেটে যায়’ (মুসলিম)।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে : ‘হে উম্মতে মুহাম্মাদী! কোনো বান্দার যিনা-ব্যভিচারে, অথবা কোনো বান্দীর যিনা-ব্যভিচারে আল্লাহ হতে অধিক গায়রতওয়ালা তথা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন অন্য কেউ নেই। হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে তবে তোমরা কম হাসতে ও বেশি কাঁদতে। আল্লাহর কসম, আমি নামাযে দাঁড়ানোর পর থেকে দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের যা যা পরিণতি হবে তা দেখেছি। আমি পূর্বে যা যা দেখিনি তা এই অবস্থানে আমি দেখেছি। এমনকি আমি জান্নাত ও জাহান্নামও দেখেছি। আমি আগুনকে দেখেছি তার একাংশ অন্য অংশকে চূর্ণ করছে। আমি আজকের মতো এত ভয়াবহ দৃশ্য আর কখনো দেখিনি। আমি জাহান্নামে আমর ইবনে লুহাই আল খুযাঈকে দেখেছি, সে তার নাড়ীভুঁড়ি টেনে বেড়াচ্ছে। আমি বনী ইসরাইলের এক নারীকে একটি বিড়ালের জন্য আযাবরত অবস্থায় দেখতে পেয়েছি। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। সে তাকে না খেতে দিয়েছে, আর না তাকে ছেড়ে দিয়েছে যাতে যমীনের পোকামাকড় খেয়ে জীবনধারণ করতে পারে। আমি তোমাদেরকে কবরে পরীক্ষারত অবস্থায় দেখেছি দাজ্জালের ফেতনার ন্যায়। তোমাদের একজনের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করা হয়,‘এই ব্যক্তির ব্যাপারে তোমাদের জ্ঞান কী? অতঃপর মুমিন ও বিশ্বাসী ব্যক্তি বলে, ‘তিনি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। তিনি আমাদের কাছে এসেছেন সুস্পষ্ট প্রমাণ ও হিদায়েত নিয়ে। আর আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছি। তাঁর অনুসরণ করেছি। অতঃপর বলা হয়, ‘তুমি নেককার ব্যক্তি হিসেবে ঘুমাও। আমরা জেনেছি যে তুমি বিশ্বাসী ছিলে। পক্ষান্তরে মুনাফিক বা সন্দেহকারী ব্যক্তি বলে, ‘আমি জানি না। লোকদেরকে কিছু একটা বলতে শুনেছি, আর আমি ও তাই বলেছি’। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হিফাযত করুন।

أَعُوْذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ: { وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ}

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ جَعَلَ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ خِلْفَةً لِمَنْ أَرَادَ أَن يَذَّكَّرَ أَوْ أَرَادَ شُكُوْرَا، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، تَعَالَى عَمَّا يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ عُلُوّاً كَبَيْرِاً، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ بَعَثَهُ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ بَشِيْراً وَنَذَيِراً وَدَاعَياً إِلَى اللهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجَاً مُنِيْراً، صَلَّىَ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ وَأَتْبَاعِهِ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيِنِ، أَمَّا بَعْدُ :

ভাইয়েরা আমার! আপনারা জাহান্নাম থেকে বাঁচুন। আগুন থেকে বাঁচুন। এক টুকরো খেজুর দান করে হলেও জাহান্নাম থেকে বাঁচুন। আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। আপনারা তাকওয়া অবলম্বন করুন। কেননা তাকওয়াই হলো উত্তম পাথেয়।

কুসূফের সময় নামাযের বৈধতা ও পদ্ধতি

কুসূফের সময় নামাযের বৈধতার ব্যাপারে বেশ কয়েকটি হাদীস উপরে উল্লিখিত হয়েছে। আর এ সময় নামাযের পদ্ধতি কি হবে তা নিচের কয়েকটি হাদীস থেকে জানা যায়।

আবদুর রাহমান ইবনে সামুরা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

( بَيْنَمَا أَنَا أَرْمِي بِأَسْهُمِي فِي حَيَاةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ انْكَسَفَتِ الشَّمْسُ، فَنَبَذْتُهُنَّ، وَقُلْتُ: لَأَنْظُرَنَّ إِلَى مَا يَحْدُثُ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي انْكِسَافِ الشَّمْسِ الْيَوْمَ، فَانْتَهَيْتُ إِلَيْهِ وَهُوَ رَافِعٌ يَدَيْهِ يَدْعُو وَيُكَبِّرُ وَيَحْمَدُ وَيُهَلِّلُ، حَتَّى جُلِّيَ عَنِ الشَّمْسِ، فَقَرَأَ سُورَتَيْنِ وَرَكَعَ رَكْعَتَيْنِ )

‘ আমি রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় তীরান্দাজী করছিলাম। এমতাবস্থায় সূর্য গ্রহণ লাগল। তখন আমি তীরগুলো ফেলে দিলাম। আর মনে মনে বললাম, সূর্য গ্রহণ লাগায় আজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কী অবস্থা হয় আমি তা অবশ্যই দেখব। অতঃপর আমি তাঁর কাছে গেলাম। তিনি দু’হাত উত্তোলন করে দু‘আ করছিলেন তাকবীর বলছিলেন, আল্লাহর প্রশংসা করছিলেন এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলছিলেন। সূর্য গ্রহণ কেটে যাওয়া পর্যন্ত তিনি এরূপ করতে থাকলেন। তিনি দু’টি সূরা পড়লেন এবং দুই রাকাআত নামায আদায় করলেন’ (মুসলিম)।

আবূ বাকরা রাযি. বলেন:

( انْكَسَفَتِ الشَّمْسُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ )

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সূর্য গ্রহণ লাগল। অতঃপর তিনি দু’রাকাআত নামায পড়লেন’ (বুখারী)।

আয়েশা রাযি. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে একবার সূর্য গ্রহণ লাগল। তখন তিনি লোকজন নিয়ে নামায পড়লেন। তিনি দীর্ঘ কিয়াম করলেন। এরপর তিনি রুকু করলেন ও রুকুতে দীর্ঘক্ষণ থাকলেন। অতঃপর তিনি দাঁড়ালেন এবং দীর্ঘক্ষণ কিয়াম করলেন। এটা রুকুর পূর্বের কিয়ামের অতিরিক্ত। তারপর আবার রুকু করলেন এবং রুকুতে দীর্ঘক্ষণ থাকলেন। এটা প্রথম রুকুর অতিরিক্ত। তারপর তিনি সিজদা করলেন এবং সিজদায় দীর্ঘক্ষণ থাকলেন। অতঃপর গ্রহণ কেটে যাওয়ার পর তিনি প্রস্থান করলেন। এরপর তিনি মানুষের সামনে বক্তৃতা করলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলী বর্ণনা করে বললেন :

( إِنَّ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ آيَتَانِ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَا يَخْسِفَانِ لِمَوْتِ أَحَدٍ وَلَا لِحَيَاتِهِ، فَإِذَا رَأَيْتُمْ ذَلِكَ فَادْعُوا اللَّهَ وَكَبِّرُوا وَصَلُّوا وَتَصَدَّقُوا، ثُمَّ قَالَ: يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ وَاللَّهِ مَا مِنْ أَحَدٍ أَغْيَرُ مِنَ اللَّهِ أَنْ يَزْنِيَ عَبْدُهُ أَوْ تَزْنِيَ أَمَتُهُ، يَا أُمَّةَ مُحَمَّدٍ وَاللَّهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلبَكَيْتُمْ كَثِيرًا )

‘ নিশ্চয় সূর্য ও চাঁদ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের দু’টি নিদর্শন। কারো মৃত্যু বা জীবনের কারণে এদের গ্রহণ লাগে না। সুতরাং তোমরা যখন তা দেখবে, তখন আল্লাহকে ডাকবে, তাকবীর বলবে, নামায পড়বে এবং সাদকা করবে। এরপর তিনি বলেন, ‘হে উম্মতে মুহাম্মাদী! আল্লাহর কোনো বান্দা যিনা-ব্যভিচার করবে অথবা তাঁর কোনো বান্দী যিনা-ব্যভিচার করবে এ ব্যাপারে আল্লাহ থেকে অধিক আত্মসম্মানবোধবিশিষ্ট অন্য কেউ নেই। হে উম্মতে মুহাম্মাদী, তোমরা যদি জানতে আমি যা জানি তবে তোমরা কম হাসতে ও অধিক কাঁদতে’ (বুখারী)।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আল্লাহ তাআলা বান্দার দু‘আ কবুল করেন। ইরশাদ হয়েছে :

{وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ }

‘তোমাদের রব বলেন, তোমরা আমার কাছে দু‘আ করো আমি তোমাদের দু‘আয় সাড়া দেব* (সূরা আল গাফের : ৬০)।

তাই আসুন আমরা দু‘আ করি যাতে তিনি আমাদেরকে সকল প্রকার বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন। আমাদের সকল পাপ ও গুনাহ ক্ষমা করে দেন।

اَللَّهُمَّ صَلِّ وَسَلِّمْ وَبَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ وَبَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيْمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيْمَ إِنَّكَ حَمِيْدٌ مَجِيْدٌ وَارْضَ اللَّهُمَّ عَنِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَعَنْ آلِ نَبِيِّكَ الطَّيِّبِيْنَ الطَّاهِرِيْنَ وَعَنْ أَزْوَاجِهِ أُمُّهَاتِ الْمُؤْمِنِيْنَ وَعَنِ الصَّحَابَةِ أَجْمَعِيْنَ وَعَنِ التَّابِعِيْنَ وَمَنْ تَبِعَهُمْ بِإِحْسَانٍ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنِ وَعَنَّا مَعَهُمْ بِمَنِّكَ وَكَرَمِكَ وَعَفْوِكَ وَإِحْسَانِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِيْنَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আপনি আমাদেরকে সকল পাপ থেকে মুক্ত করে পূতপবিত্র করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন না। আপনার অসীম দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত করবেন না। রাব্বুল আলামীন! আমাদেরকে আপনি দুনিয়া-আখিরাতের সকল আযাব থেকে রক্ষা করুন। সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুন। আপনি আমাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্র“র হিফাযত করুন। আমাদেরকে মুনাফিকী থেকে হিফাযত করুন। আপনি আমাদের জন্য জান্নাতের ফয়সালা করুন। জাহান্নাম থেকে আমাদের সকলকে বাঁচান। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : ( إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.