islamkingdomfacebook islamkingdomtwitte islamkingdomyoutube


প্রতিবেশীর অধিকার


15238
পাঠ সংক্ষেপ
মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। আর সমাজে বসবাস করলে অবশ্যই সেখানে প্রতিবেশী থাকে। প্রতিবেশী ভালো হলে সামাজিক জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়। এর বিপরীতে প্রতিবেশী মন্দ হলে সমস্যার কোনো শেষ থাকে না। তাই ইসলামে প্রতিবেশী নির্বাচনের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হল, সব সময় সৎ প্রতিবেশী বেছে নেয়ার দিকে দৃষ্টি দেয়া; যে তার অধিকারগুলো আদায় করবে; এবং তাকে কষ্ট দেবে না; যে তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। বলা হয় ‘বাড়ি বানানোর পূর্বে প্রতিবেশী নির্বাচন কর’।

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ خَلَقَ مِنَ الْمَاءِ بَشَراً فَجَعَلَهُ نَسَباً وَصِهْراً، وَأَوْجَبَ صِلَةَ الْقُرْبَىَ وَأَعْظَمَ فِيْ ذَلِكَ أَجْرَاً، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَاشَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَمَّا بَعْدُ : فَاتَّقُوا اللهَ عِبَادَ اللَّهِ حَقَّ التَّقْوَى، فَإِنْ مَنِ اتَّقَى رَبَّهُ وَقَاهُ، وَمَنْ تَوَكَّلَ عَلَيْهِ كَفَاهُ، أَمَّا بَعْدُ :

সম্মানিত মুসল্লীবৃন্দ! আমরা আজ আলোচনা করব এমন একটি বিষয়ে প্রতিটি মানুষ যার প্রয়োজন অনুভব করে প্রতিটি মুহূর্তে। যে বিষয়ে সচেতন ও দায়িত্ববান না হলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তার আশা করা যায় না। বরং বলা যায় জীবনে পূর্ণতাই আসে না। জীবনকে অর্থবহ ও অনাবিল সুখময় করতে হলে সে বিষয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হয় যথাযথভাবে। বিষয়টির সাথে আমরা সকলেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিষয়টি হলো, ‘প্রতিবেশী ও তার অধিকার’।

বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, জিবরীল আলাইহিস সালাম বার বার মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছিলেন, এক পর্যায়ে নবীজির প্রবল ধারণা জন্মেছিল আল্লাহ হয়তো প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারীই বানিয়ে দেবেন।

প্রিয় হাযেরীন! প্রতিবেশী মূলত নিজ বাড়ির আশে পাশে বসবাসকারীকে বলা হয়। সে মুসলিমও হতে পারে আবার অমুসলিমও। পূন্যবানও হতে পারে আবার পাপীও। সফর সঙ্গী অথবা কাজের সঙ্গীকেও প্রতিবেশী বলা হয়। অনুরূপভাবে বাজার, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির অভিন্নতার দিক থেকেও প্রতিবেশী হতে পারে। নিজ দেশের পার্শ্ববর্তী দেশও প্রতিবেশীর অন্তর্ভুক্ত। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের ওপর প্রতিবেশী দেশেরও নানা অধিকার রয়েছে। সুন্দর সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য তার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক।

প্রতিবেশীই হচ্ছে মানুষের সবচে’ নিকটজন, যে তার খবরা-খবর সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় বেশি জানে। ইসলামী শরীয়তে প্রতিবেশীর প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং তার অধিকার খুব বড় করে দেখা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন :

{وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا}

‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী’ (সূরা আন নিসা : ৩৬)

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(مَا زَالَ يُوصِينِي جِبْرِيلُ بِالْجَارِ حَتَّى ظَنَنْتُ أَنَّهُ سَيُوَرِّثُهُ .)

‘ জিবরীল আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে অনবরত অসিয়ত করতে থাকেন, এমনকি এক পর্যায়ে আমার ধারণা হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেবেন’ (বুখারী ও মুসলিম)।

সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:

(مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ لِيَصْمُتْ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ، وَمَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَهُ.)

‘ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন কল্যাণমূলক কথা বলে না হয় নিশ্চুপ থাকে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীর সম্মান রক্ষা করে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন নিজ মেহমানের মেহমানদারী করে’ (বুখারী ও মুসলিম)।

এরূপ অসংখ্য হাদীস রয়েছে যা প্রতিবেশীর অধিকারের অপরিহার্যতার কথা প্রমাণ করে।

শরীয়ত প্রতিবেশীকে এত অধিক গুরুত্ব দেয়ার কারণ

প্রিয় মুসল্লীবৃন্দ! প্রতিবেশীর প্রতি ইসলাম এত গুরুত্ব দেয়ার বেশ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা এখানে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে চাই :

১)সকল মুসলমানকে ভালোবাসা, তাদের কল্যাণ কামনা করা, বিপদে সাহায্য করা ইত্যাদি হিতকর যাবতীয় কাজ ইসলামে প্রতিটি মুসলমানের ওপর আবশ্যক করা হয়েছে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের নাম রাখা হয়েছে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব। এই ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর এ ভালোবাসা ও পারস্পরিক মমত্ববোধের প্রসার মুসলমানদের মাঝে ব্যাপকভাবে যাতে ঘটতে পারে, তাই প্রতিবেশীর প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

২)প্রতিবেশী সকলের চেয়ে অধিক সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার দাবী রাখে, কারণ প্রতিবেশীই তার অতি নিকটে বসবাস করে এবং সে তার যাবতীয় সমস্যা ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি জানে।

৩)প্রতিবেশীর দ্বারাই মুসলমানের নিজ জীবন, সন্তান, পরিবার এবং সম্পদের নিরাপত্তা লাভ হয়। এবং সর্বাঙ্গীন জীবন সুখময় হয়।

প্রতিবেশী কারা ?

প্রিয় উপস্থিতি! প্রতিবেশী কে? এ ব্যাপারে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হলো- আপনার বাড়ির কাছাকাছি যার বাড়ি এবং যার বাড়ির সাথে আপনার বাড়ি মেলানো সেই আপনার প্রতিবেশী। সীমানা নির্ধারিত হবে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী। যে ব্যক্তি সমাজে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী প্রতিবেশী, সেই প্রতিবেশী।

প্রতিবেশীর গুরুত্বের ক্ষেত্রে তারতম্য

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! সকল প্রতিবেশীর গুরুত্ব আবার সমান নয়। বিভিন্ন দিকের বিবেচনায় তাদের গুরুত্বের মধ্যেও তারতম্য হবে। যেমন গুরুত্বের মধ্যে তারতম্য আসবে নিকটবর্তী ও দূরবতী প্রতিবেশী হওয়ার দিক বিবেচনায়। নিকটবর্তী প্রতিবেশী কল্যাণ এবং সাহায্য পাবার ক্ষেত্রে দূরবর্তী প্রতিবেশীর চেয়ে অধিক গুরুত্ব পাবে। এর প্রমাণ আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত হাদীস :

(إِنَّ لِي جَارَيْنِ فَإِلَى أَيِّهِمَا أُهْدِي؟ قَالَ: إِلَى أَقْرَبِهِمَا مِنْكِ بَابًا)

‘ আমার দু’জন প্রতিবেশী আছে। তাদের মধ্যে কাকে আমি হাদিয়া দেব? রাসূলুল্ল¬াহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : ‘তোমার দরজার অধিক নিকটবর্তীজনকে’ (বুখারী)।

অনুরূপভাবে তাদের শ্রেণী ও মর্যাদার তারতম্যের কারণেও গুরুত্বের মধ্যে তারতম্য হবে :

১)এক ধরনের প্রতিবেশী আছে যার অধিকার তিনটি। আর সে হলো নিকটাত্মীয়-মুসলমান-প্রতিবেশী। তার অধিকার তিনটি হলো : আত্মীয়তা, ইসলাম ও প্রতিবেশীত্ব।

২)আরেক ধরনের প্রতিবেশী আছে যার অধিকার দু’টি। আর সে হলো অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী। এ প্রতিবেশীর অধিকার হলো প্রতিবেশীত্ব ও ইসলাম ।

৩)আরেক ধরনের প্রতিবেশী রয়েছে, যার অধিকার একটি। আর সে হলো অমুসলিম প্রতিবেশী। এ প্রতিবেশীর অধিকার শুধু প্রতিবেশীত্ব।

প্রতিবেশী নির্বাচনের গুরুত্ব

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! মানুষ হিসাবে আমাদেরকে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। আর সমাজে বসবাস করলে অবশ্যই সেখানে প্রতিবেশী থাকে। প্রতিবেশী ভালো হলে সামাজিক জীবন সুন্দর ও মধুময় হয়। এর বিপরীতে প্রতিবেশী মন্দ হলে সমস্যার কোনো শেষ থাকে না। তাই ইসলামে প্রতিবেশী নির্বাচনের প্রতি অত্যাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য হল, সব সময় সৎ প্রতিবেশী বেছে নেয়ার দিকে দৃষ্টি দেয়া যে তার অধিকারগুলো আদায় করবে এবং তাকে কষ্ট দেবে না যে তাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। বলা হয় ‘বাড়ি বানানোর পূর্বে প্রতিবেশী নির্বাচন কর’। এর স্বপক্ষে পবিত্র কোরআনের ঐ আয়াত পেশ করা যেতে পারে যেখানে আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউনের স্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন :

{وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ}

‘আর যারা ঈমান আনে তাদের জন্য আল্লাহ ফিরআউনের স্ত্রীর উদাহরণ পেশ করেন, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার রব, আপনার কাছে আমার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফিরআউন ও তার কর্ম হতে নাজাত দিন, আর আমাকে নাজাত দিন যালিম সম্প্রদায় হতে’ (সূরা আত-তাহরীম : ১১)

সৎ প্রতিবেশী নির্বাচন করার গুরুত্ব এর মাধ্যমেও স্পষ্ট হয় যে, এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশী ও তার সন্তানদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে থাকে, পরস্পর মেলা-মেশা ও দেখা-সাক্ষাতের কারণে। সে হিসেবে প্রতিবেশী যদি সৎ হয় তাহলে ব্যক্তির ঘর ও পরিবার নিরাপদ হয়ে যায়। আর যদি অসৎ হয়, তাহলে উদ্বেগ উৎকন্ঠা ও অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভালো প্রতিবেশী তার প্রতিবেশীর গোপন বিষয় অবহিত হলে গোপন রাখে। আর অসৎ প্রতিবেশী তা প্রকাশ ও প্রচার করে বেড়ায়। ভালো প্রতিবেশী ভালো কাজে সাহায্য করে, সৎ উপদেশ দেয়। আর অসৎ প্রতিবেশী ধোঁকা দিয়ে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। আল্লাহ আল্লাহ আমাদের সবাইকে যথার্থরূপে প্রতিবেশী যাবতীয় অধিকার আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

أعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ : {وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا }( سورة الأحزاب : 58)

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْمِ, أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور ُالرَّحِيْمْ .

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ حَمْداً كَثِيْراً كَمَا يُحِبُّ رَبُّنَا وَيَرْضَى، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، لَهُ الْحَمْدُ فِيْ الْآخِرَةِ وَالْأُوْلَى، وَأَشْهَدُ أَنَّ نَبِيَّنَا مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَأَصْحَابِهِ أَجْمَعِيْنَ، أَمَّا بَعْدُ: فَاتَّقُوا اللهَ عِبَادَ اللَّهِ حَقَّ التَّقْوَى، فَإِنَّ مَنِ اتَّقَى رَبَّهُ وَقَاهُ، وَمَنْ تَوَكَّلَ عَلَيْهِ كَفَاهُ.

সুপ্রিয় মুসলিম ভাই ও বন্ধুগণ! প্রতিবেশীর অনেক অধিকার রয়েছে। তার মধ্য থেকে আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধিকার তুলে ধরছি :

প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়া :

ব্যক্তি তার প্রতিবেশী থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। কোনো ব্যক্তিই তার প্রতিবেশীকে কোনোরূপ কষ্ট দেবে না, নির্যাতন করবে না, হয়রানিতে ফেলবে না। হোক তা কথা অথবা কাজের মাধ্যমে। যেমন অভিশাপ দেয়া, গালমন্দ করা, গীবত করা এবং এমন কথা বলা যা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। তদ্রুপভাবে প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলা, তাকে বিরক্ত করা, ছেলে মেয়েদেরকে প্রতিবেশীর ঘরের জিনিস-পত্র নষ্ট করতে উদ্বুদ্ধ করা বা বাধা না দেয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :

(وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، وَاللَّهِ لَا يُؤْمِنُ، قَالُوا: وَمَا ذَاكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: الْجَارُ لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ)

‘আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, আল্লাহর কসম সে মুমিন নয়, আল্ল¬াহর কসম সে মুমিন নয়, প্রশ্ন করা হলো কে সে হে আল্লাহর রাসূল ? তিনি বললেন : ‘প্রতিবেশী, যার কষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়’ (আমহদ)।

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন :

(لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ، مَنْ لَا يَأْمَنُ جَارُهُ بَوَائِقَهُ)

‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না যার প্রতিবেশী তার কষ্ট থেকে নিরাপত্তা বোধ করে না’ (মুসলিম)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যত্র বলেন :

(مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلَا يُؤْذِ جَارَهُ،)

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়’ (বুখারী)।

প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়ার সবচেয়ে কঠিন প্রকার হল : তার সম্মান-সম্ভ্রমে আঘাত আসে এমন কাজ করা, যেমন প্রতিবেশীর স্ত্রী-কন্যাদের প্রতি লোলুপদৃষ্টি নিক্ষেপ করা। তাদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলা ইত্যাদি। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেন :

(أَيُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ؟ قَالَ: أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ ، قُلْتُ: إِنَّ ذَلِكَ لَعَظِيمٌ، قُلْتُ: ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: وَأَنْ تَقْتُلَ وَلَدَكَ تَخَافُ أَنْ يَطْعَمَ مَعَكَ ، قُلْتُ: ثُمَّ أَيُّ؟ قَالَ: أَنْ تُزَانِيَ حَلِيلَةَ جَارِكَ)

‘ আল্লাহ তা‘আলার নিকট সবচেয়ে’ বড় গুনাহ কোন্টি’ ? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করা অথচ তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি বললাম, ‘তারপরে কোন্টি’ ? তিনি বললেন, ‘তোমার সাথে খাবে এ ভয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করা। আমি বললাম, ‘এরপর কোন্টি’? তিনি বললেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা’ (বুখারী)।

অর্থাৎ প্রতিবেশীর স্ত্রীকে ফুসলিয়ে তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে তার সাথে ব্যভিচার করা। কারো অসম্মতিতে জোর পূর্বক ব্যভিচার করা থেকে এটা আরো বেশি অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে হিফাযত করুন।

শরীয়তে এ বিষয়টি বড় করে দেখার কারণ :

ক) এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর নিকট আমানতস্বরূপ, তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা উক্ত আমানতের খিয়ানত।

খ) এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীর যাবতীয় অবস্থা এবং তার উপস্থিতি- অনুপস্থিতির সময় সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।

গ) প্রতিবেশী যেহেতু তার কাছাকাছিই থাকে এবং তার সাথে ওঠাবসা করে তাই তার দেয়া কষ্ট প্রতিবেশীর নিকট খুবদ্রুত এবং সহজেই পৌঁছে ।

ঘ) যিনা-ব্যভিচার মারাত্মক অন্যায়। ইসলাম মুসলমানদেরকে এ ব্যাধি থেকে নিবৃত রাখার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। এর জন্য মারাত্মক শাস্তির বিধান প্রবর্তন করে সতর্ক করেছে কিন্তু প্রতিবেশী অতি নিকটে বসবাস করে বিধায় এ অন্যায়কর্মটি সঙ্ঘটিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা অন্য জায়গার তুলনায় একটু বেশি। তাই এখানে শাস্তি ও অন্যায়ের মাত্রা বেশি বলে অতিরিক্ত সতর্ক করা হয়েছে। যাতে আল্লাহভীরু মুসলমান পাপের আধিক্যের কথা চিন্তা করে এ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।

প্রতিবেশীর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা :

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন :

(مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيُكْرِمْ جَارَهُ)

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীকে সম্মান করে’ (বুখারী)।

কাযী আয়ায রহ. বলেন, হাদীসের অর্থ হলো, যে ব্যক্তি ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলার সঙ্কল্প করেছে, ইসলামকে মান্য করা নিজের ওপর আবশ্যিক করেছে। তার ওপর নিজ মেহমান ও প্রতিবেশীকে সম্মান করা, তাদের মান্য করা ও খেদমত করা অবশ্য কর্তব্য। আর এটিই হলো প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণ ও আদায় করার অর্থ (ইমাম নববী, শারহু সহীহিল মুসলিম)।

আর এটি হলো ব্যাপক ভিত্তিক অধিকার। এর সাথে অনেকগুলো অধিকার ও বিষয় জড়িত। যেমন-

ক) তার প্রয়োজনে সাহায্য করা, ব্যবহারের জিনিস চাইলে দেয়া। কেননা প্রতিবেশী কখনও প্রতিবেশীর কাছে মুখাপেক্ষী নয়, এমন হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা ঐ সমস্ত লোকের নিন্দা করেছেন, যারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস চাইলে দেয় না। ইরশাদ হয়েছে :

{وَيَمْنَعُونَ الْمَاعُونَ}

‘তারা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস অন্যকে দেয় না (সূরা আল-মাউন : ৭)

খ) প্রতিবেশীকে হাদিয়া দেয়া, তার বাড়িতে খাবার ইত্যাদি প্রেরণ করা।

আবু যর রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে অসিয়ত করেছে

( إِذَا طَبَخْتَ مَرَقًا فَأَكْثِرْ مَاءَهُ، ثُمَّ انْظُرْ أَهْلَ بَيْتٍ مِنْ جِيرَانِكَ، فَأَصِبْهُمْ مِنْهَا بِمَعْرُوفٍ)

‘ তুমি যখন তরকারি রান্না করবে তখন তাতে বেশি করে পানি দেবে অতঃপর তোমার প্রতিবেশীদের কারো খবর নিয়ে তা থেকে তাদেরকে কিছু দেবে’ (মুসলিম)।

গ) প্রতিবেশী ঋণ চাইলে তাকে ঋণ দেয়া, তার প্রয়োজনে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করে তার দেখাশোনা করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন :

(لَيْسَ الْمُؤْمِنُ الَّذِي يَشْبَعُ، وَجَارُهُ جَائِعٌ إِلَى جَنْبِهِ)

‘সে মুমিন নয় যে পেট ভরে খায় অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে’ (বায়হাকী : আসসুনানুল কুবরা: সহীহ আত-তারগীবে আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ লিগাইরিহি বলেছেন)।

ঘ) প্রতিবেশীর ভালো কোন সংবাদ পেলে তাকে মুবারকবাদ জানানো এবং খুশি প্রকাশ করা। যেমন বিবাহ করলে, সন্তান জন্ম নিলে, সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এবং এ জাতীয় উপলক্ষ্যে মুবারকবাদ জানানো এবং বরকতের জন্য দুআ করা।

ঙ) মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের যে অধিকার রয়েছে সেগুলো প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেও আদায় করা জরুরী। কেননা সে-ই এর বেশি হকদার, যেমন তাকে সালাম দেয়া, সালামের উত্তর দেয়া, অসুস্থ হলে খেদমত করা, তার দাওয়াত গ্রহণ করা। নিম্নবর্ণিত হাদীসে সুস্পষ্টভাবে এ সবের উল্লেখ রয়েছে:

(عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- قَالَ: حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ قِيلَ مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ : إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَشَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ)

‘ আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক মুসলমানের প্রতি অপর মুসলমানের অধিকার ছয়টি: বলা হলো, সেগুলো কি হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, যখন তার সাথে সাক্ষাত হবে তাকে সালাম দেবে দাওয়াত দিলে কবুল করবে তোমার কাছে নসীহত চাইলে নসীহত করবে হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে ‘ইয়ারহামকাল্লাহ’ বলে জবাব দিবে অসুস্থ হলে তার খোঁজ-খবর নেবে আর মৃত্যু বরণ করলে জানাযা ও দাফন-কাফনে অংশ গ্রহণ করবে’ (মুসলিম)।

সম্মানিত মুসল্লীবৃন্দ! এ ছিল প্রতিবেশীর অধিকার সংক্রান্ত কিছু জরুরী কথা। সহীহ কথাগুলোর ওপর আল্লাহ আমাদের সকলকে আমল করার তাওফীক দান করুন এবং প্রতিবেশীর যে অধিকার মহান আল্লাহ আমাদের জন্য আদায় করা জরুরী করে দিয়েছেন আমাদের সকলকে সে অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তা যথার্থরূপে আদায় করার তাওফীক দিন।

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আপনি আমাদেরকে সকল পাপ, অন্যায় ও গুনাহ থেকে পবিত্র করুন। আপনি আমাদেরকে প্রতিবেশীর অধিকার যথার্থরূপে আদায় করার তাওফীক দিন। হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিবেশীদেরকেও আপনি প্রতিবেশীর হক ও অধিকার বিষয়ে সচেতন হওয়ার তাওফীক দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যথার্থরূপে তাকওয়া অবলম্বনের তাওফীক দিন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله : (إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.